শ্রীলংকা থেকে নেপাল: অভিজাতদের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে একটি জোরালো বার্তা
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম

দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় আন্দোলনের সূচনা হয়। ২০২২ সালের মার্চে দেশ দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। দৈনন্দিন জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং, জ্বালানি ও গ্যাসের জন্য দীর্ঘ লাইন, আর মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। শুরু হয় ‘আরাগালায়া’ বা ‘সংগ্রাম’ আন্দোলন। তরুণেরা প্রেসিডেনশিয়াল সচিবালয়ের সামনে তৈরি করেন ‘গোতাগোগামা’ (গোতা গো ভিলেজ) নামের বিক্ষোভকেন্দ্র। এটি ছিল প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ। জায়গাটি হয়ে ওঠে সমাবেশ, শিল্পকর্ম আর বক্তৃতার কেন্দ্রস্থল। জুলাইয়ের মাঝামাঝি রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তাঁর সরকারি বাসভবন দখল করে নেন বিক্ষোভকারীরা। এর আগে গোতাবায়া পরিবার ১৫ বছর দেশ শাসন করে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী স্বতন্ত্র উত্থান ঘটে। পূর্বেকার সকল রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাধারণ জনগণ সম্পৃক্ত হয়েছিল ও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলন ও শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনে রূপান্তরিত হয়েছিল সেটা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা দেখিয়েছে। প্রাথমিকভাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল ঢিলেঢালা। ছাত্রনেতারা আলটিমেটাম ও দাবি পেশ করছিলেন। হাসিনা সরকারের দমননীতি, ছাত্রদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা থেকে শুরু করে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটানো-পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। “লেথাল উইপন” ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েও ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার মসনদ টিকিয়ে রাখতে পারেনি। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা পদত্যাগ করে এবং হেলিকপ্টারে করে ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতে পালিয়ে যান। এই আন্দোলনে ৬ মাস বয়সী শিশুসহ প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতা প্রাণ হারায়। নেপালের উদীয়মান গণতন্ত্রের ক্ষীণ ইতিহাসে ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে বিবেচিত হবে। সেদিন প্রথমবারের মতো তরুণ বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বালুওয়াতারে প্রবেশ করে। মাসের পর মাস ধরে চলা অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটে, যা ইতিমধ্যেই জনসাধারণের আস্থা ক্ষুন্নকারী অভিজাতদের দখলের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা তুলে ধরেছিল।
কাঠমান্ডুর দৃশ্যপট কেবল জাতীয় অভিযোগের চেয়েও বিশ্বব্যাপী বৈধতার সংকটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া কিন্তু অর্থনৈতিক সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া রাষ্ট্রগুলি অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হয়েছিল। তরুণ নেপালিরা কেবল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি, রাষ্ট্রকে তাদের জন্য কাজ করতে বাধ্য করার জন্যতাদের সম্মিলিত ক্ষোভ জেগে উঠেছিল। বিদ্রোহের প্রতীকী ব্যাকরণ এটিকে অনন্য করে তুলেছিল। তাদের প্রতীকগুলি ভাইরাল হয়ে পদ্ধতিগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। স্বজনপ্রীতি এবং পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা বিকৃত একটি ব্যবস্থায় শিক্ষার অর্থায়নের অর্থহীনতার স্পষ্ট স্মারক হিসাবে, বিক্ষোভকারীরা স্কুলের পাঠ্যপুস্তক ধরে রেখেছিল।
শাসকগোষ্ঠীর একই কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠিত দলগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভকারীরা ঘোষণা করে যে তারা তাদের রাজনৈতিক ব্যবসাকেন্দ্রের প্রতি চরম বিরক্ত। তাদের বর্জন এতটাই সম্পূর্ণ ছিল যে অনেকেই ভেতর থেকে সংস্কারের কথা ছেড়ে দিয়ে পুরো বন্দোবস্তকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিল। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের তাজা গোলাবারুদের ব্যবহার অস্থিরতাকে পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছিল। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল কর্মক্ষমতার কারণে ইতিমধ্যেই ক্ষয়প্রাপ্ত সরকারের বৈধতার শেষ চিহ্নটিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে সংঘটিত সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রজন্মগত বিদ্রোহ দক্ষিণ এশিয়াকে নাড়া দিয়েছে। মূলতঃ দক্ষিণ এশিয়া বিদ্রোহের একটি অঞ্চল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশে সংঘটিত প্রতিটি বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতার গভীর অনুভূতি দ্বারা একত্রিত এবং প্রতিটি বিপ্লবের নিজস্ব শব্দভাণ্ডাররয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস, রিজার্ভ হ্রাস, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঘাটতি ও উর্ধ্বগতি এবং চরম দুর্নীতি ও অর্থপাচারের ফলে চরম মুদ্রাস্ফীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছিল। তরুণদের কাছে রাজনীতি ছিল বেঁচে থাকা, মর্যাদা এবং শোনার অধিকারের বিষয়। বিদ্রোহী গান, কবিতা, গ্রাফিতি ও বৈষম্যবিরোধী শ্লোগানে মুখর ছিল রাজপথ।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের আন্দোলনের পেছনে প্রতিটির নিজস্ব ইতিহাস ও অনন্য প্রেক্ষাপট আছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মধ্যে মিলও আছে-নতুন প্রজন্ম আর ভাঙা প্রতিশ্রুতি মেনে নিচ্ছে না।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন- “এসব আন্দোলনের আসল শক্তি হলো তরুণদের স্বপ্ন দেখা-একটা ভালো রাজনীতি আর ভালো অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কল্পনা করার ক্ষমতা। কিন্তু সেই কল্পনার সঙ্গে বাস্তব জীবনের বড় পার্থক্য তাঁরা বুঝতে পারছেন। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের এ ফারাকই তাঁদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে।”
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়ার উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি মনে করেন- “তিন দেশের আন্দোলনের মূল কারণ এক-বৈষম্য আর দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি। এ শ্রেণি তরুণ প্রজন্মের বাস্তব চাওয়া-পাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।”
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুমেলা সেন আল-জাজিরাকে বলেন- “এসব দেশে বাইরে থেকে
শুধু ক্ষোভের ছবি দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে ভেতরে আছে-গণতন্ত্রের প্রতি আকাঙক্ষা, রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের দাবি আর নির্বাচিত নেতাদের জবাবদিহি করানোর প্রত্যাশা।”
তরুণ জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ। তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে সহজেই কাজে লাগাচ্ছে সংগঠন গড়ে তোলা, মতপ্রকাশ ও সংযোগ তৈরির জন্য। ইন্টারনেট বা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার চেষ্টা উল্টো সরকারের বিরুদ্ধে গেছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রুমেলা সেন বলেন- “নেপালসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর আন্দোলনে যে কৌশল দেখা যাচ্ছে, যেমন সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ প্রচার আর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই সংগঠিত হওয়া-এগুলো আসলে নতুন ধরনের ডিজিটাল আন্দোলনের কৌশল।”
এখন প্রশ্নটা শুধু একটাই-পরবর্তী আন্দোলন কোথায় শুরু হবে?
(আল জাজিরা নয়াদিল্লী অবলম্বনে)